১৪ শা'বান দিবাগত রাত (লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান) সম্পর্কে পাঁচটি হাদিস ও পাঁচ জন আলিমের বক্তব্য

 ১৪ শা'বান দিবাগত রাত (লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান) সম্পর্কে পাঁচটি হাদিস ও পাঁচ জন আলিমের বক্তব্য:

••••••••••••••••••••••••••••
শাবানের মধ্য রজনী ফযীলতপূর্ণ একটা রাত। মুসলিম সমাজে এই রাত নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। আমি বিতর্ক না করে বরং পাঁচটি হাদিস এবং পাঁচ জন বিশিষ্ট আলিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করব, যা পড়ে পাঠক নিজেই সিদ্ধান্ত নিবেন এই রাতে কী করবেন। শুধু বিতর্ক করে মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। যে রাতের ফযীলত সম্পর্কে হাদিসে সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সে রাতে পারলে আমল করুন, না পারলে চুপচাপ থাকার চেষ্টা করুন। হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করলে সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত হবেন।
.
✓হাদিস:-০১:
হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন,
يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
“আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির দিকে শাবানের মধ্যরাতে দৃষ্টি দেন। অতঃপর তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে মাফ করে দেন, শুধুমাত্র মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত”। (সহিহ ইবনে হিব্বান, ইবনে মাজাহ)
* শায়খ আলবানীর তাহকীক অনুযায়ী হাদিসটি হাসান।
* ইমাম হাইসামী এ হাদীস প্রসঙ্গে বলেন:
رواه الطبراني في الكبير والأوسط ورجالهما ثقات.
“হাদীসটি ইমাম তাবারানী তাঁর আল-মু‘যাম আল-কাবীর ও আছ-ছগীরের মধ্যে রিওয়ায়িত করেছেন। এ দুটোতেই হাদীসটির বর্ণনাকারীরা নির্ভরযোগ্য”।
✓হাদিস:-০২:
হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন,
(إذا كانت ليلة النصف من شعبان ينزل الله تبارك وتعالى إلى سماء الدنيا فيغفر لعباده إلا ما كان من مشرك أو مشاحن لأخيه
“যখন শাবানের মধ্য রাত আসে, আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন। তারপর সব বান্দাকে মাফ করে দেন। শুধুমাত্র মুশরিক ও যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি শত্রুতাভাবাপন্ন তাদেরকে ছাড়া”।
ইমাম হাইসামী مجمع الزوائد এ বলেন:
رواه البزار وفيه عبد الملك بن عبد الملك ذكره ابن أبي حاتم في الجرح والتعديل ولم يضعفه وبقية رجاله ثقات
“হাদীসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে আবদুল মালিক বিন আবদিল মালিক নামে একজন রাবী আছেন। ইবনু আবি হাতিম আল-জারহ অত-তাদিল কিতাবে তার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেন নি। এছাড়া, সনদের অন্যান্য সব রাবী (বর্ণনাকারী) বিশ্বস্ত”।
✓হাদিস:-০৩:
আবু মুসা আশ‘আরী (রা.) রাসূল (স.) থেকে বর্ণনা করেন,
إِنَّ اللَّهَ لَيَطَّلِعُ في لَيْلَةِ النِّصْفِ من شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خلقة إلا لِمُشْرِكٍ أو مُشَاحِنٍ
“নিশ্চয়ই আল্লাহ অর্ধ শাবানের রাত্রিতে তাকান। তারপর মুশরিক ও মুশাহিন (অন্যের প্রতি বৈরিভাব পোষণকারী) ব্যতীত তাঁর সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন”।
ইমাম ইবনু মাজাহ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
আলবানী বলছেন, حديث حسن এটি একটি হাসান হাদীস।
✓হাদিস:-০৪:
হযরত আবু হুরায়রার হাদীস:
عن أبي هريرة قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: إذا كان ليلة النصف من شعبان يغفر الله لعباده إلا لمشرك أو مشاحن
হযরত আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেন, “যখন অর্ধ শাবানের রাত্রি আসে, আল্লাহ তাঁর সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক ও মুশাহিন ব্যতীত”।
ইমাম ইবনুল হাইসামী এ হাদীস প্রসঙ্গে বলেন, “হাদীসটি ইমাম বাযযার বর্ণনা করেছেন। এর সনদের মধ্যে হিশাম বিন আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি আছেন। তাকে আমি চিনি না। তবে অন্যান্য সবাই নির্ভরযোগ্য”।
✓হাদিস:-০৫:
হযরত ‘আইশার হাদীস:
ইমাম তিরমিযি হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
فَقَدْتُ رَسُولَ الله -صلى الله عليه وسلم- لَيْلَةً فَخَرَجْتُ فإذا هو بِالْبَقِيعِ فقال: أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ الله عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ، قلت: يا رَسُولَ اللَّهِ إني ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فقال: إِنَّ اللَّهَ عز وجل يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ من شَعْبَانَ إلى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لِأَكْثَرَ من عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ
“একদা রাত্রিতে আমি রাসূল (স.) কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই তার সন্ধানে বের হলাম। জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে তাকে পেলাম। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভেবেছিলাম, আপনি অপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন এবং বনী কালবের ছাগল পালের লোমের চেয়ে অধিক পরিমাণ মানুষের গুনাহ মাফ করে দেন”।
ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন,
حَدِيثُ عَائِشَةَ لَا نَعْرِفُهُ إلا من هذا الْوَجْهِ من حديث الْحَجَّاجِ وسَمِعْت مُحَمَّدًا يُضَعِّفُ هذا الحديث
“‘আইশার হাদীসটি হাজ্জাজের এই সূত্র ছাড়া অন্য কোন ধারা থেকে আমাদের জানা নেই। মুহাম্মাদ এই হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন বলে শুনেছি”।
হাদীসটি আরো বর্ণনা করেছেন ইবনু মাজাহ, ইবনু আবি শাইবাহ, আহমাদ বিন হাম্বল।
.
উপর্যুক্ত হাদীসগুলোর সনদসমূহ কিছু হাসান, আবার কিছু দুর্বল। তবে সবগুলো একত্রিত করলে এ কথা না বলে কোন উপায় নেই যে, এ রাতটির ফজিলত একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য।
বর্ণনার সবগুলো ধারা একত্রিত করলে হাদীসগুলোর সর্ব নিন্মস্তর হবে ‘হাসান লিগইরিহা’। অনেক গবেষক আবার স্পষ্ট করে বলছেন যে, এদের সবগুলো ধারা সমন্বিত করলে ‘ছহীহ লিগইরিহা’র পর্যায়ভুক্ত হবে। কারণ এগুলো যে সব ধারাই বর্ণিত হয়েছে, তাতে নিজেরাই ‘হাসান’ হিসেবে গণ্য।
.
(১) হাফিজ ইবনু রজব (র.) বলেন,
اختلف فيها، فضعفها الأكثرون، وصحح ابن حبان بعضها، وخرجه في صحيحه.
অর্ধ শাবানের রাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। অনেকেই এগুলোকে দুর্বল বলেছেন। ইবনু হিব্বান এদের কিছুকে ছহীহ বলেছেন এবং তার ছহীহ কিতাবের মধ্যে তাখরীজ করেছেন।
(২) ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (র.) বলেন,
وأما ليلة النصف من شعبان ففيها فضلٌ، وكان في السلف من يصلي فيها، لكنَّ الاجتماع فيها لإحيائها في المساجد بدعةٌ، وكذلك الصلاة الألفية
“অর্ধ শাবানের রাতের মাহাত্ম্য রয়েছে। সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে নামায পড়তেন। তবে মসজিদের মধ্যে এ রাতে ইবাদাতের জন্য একত্রিত হওয়াটা বিদ‘আত। অনুরূপ আলফিয়্যাহ নামক বিশেষ নামায আদায় করা (ও বিদ‘আত)”।
(৩) ইমাম ইবনু নুজাইম আল-মাসর বলেন,
“যে রাতগুলোকে জাগ্রহ রাখা মুস্তাহাব, সেগুলো হচ্ছে: রমাদানের দশরাত্র, দুই ঈদের দুই রাত্র, জিলহাজ্জ মাসের দশ রাত্র ও শাবানের মধ্যরাত্র। "
(৪) আল্লামা মুবারাকপুরী তার “তুহফাতুল আহওয়াজী” নামক গ্রন্থে বলেন,
“অর্ধ শাবানের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলো সামষ্টিকভাবে প্রমাণ করে যে, এ রাতের একটি ভিত্তি আছে। এসব হাদীস সামষ্টিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ যারা মনে করে অর্ধ শাবানের রাতের ব্যাপারে কিছুই সাব্যস্ত হয়নি। আল্লাহই ভালো জানেন”।
(৫) আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী অর্ধ শাবানের রাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি কথা শুরু করেছেন এভাবে,
حديث صحيح روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضاً
“হাদীসটি সহিহ। একদল সাহাবী থেকে বিভিন্ন সূত্রে তা বর্ণিত হয়েছে। যাদের একটি আরেকটিকে মজবুত করে”।
এই রাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। আর যারা বলেন এই রাতের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই তারাও এইরকম উগ্রপন্থা পরিহার করুন। সর্বোপরি শিরক ও হিংসা ছাড়তে হবে; অন্যথায় শবে বরাতের ফযীলত পাওয়া যাবে না। এই মহিমান্বিত রাতে সাধ্যমতো আমল করুন, তাওবা-ইসতিগফার করুন।
.
আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের ক্ষমা করে দেন। জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেন।
আমিন।
লিখেছেন Muhibur Rahman হাফি:

No comments

Powered by Blogger.